এবারের ডেঙ্গু কেনো আলাদা?:
এবারের ডেঙ্গু জ্বরের সাথে আগের মিল নেই। নতুন কোন শক্তিশালী ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে ছড়ানো এই অসুখ এবার ঢাকায় রীতিমতো মহামারি আকার ধারণ করেছে। হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। ইতোমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৫০০+।
এবারের ডেঙ্গু জ্বর খুব দ্রুত হার্ট, কিডনি, ব্রেইনকে এফেক্ট করছে, যার ফলে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর ঝুকি বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। প্লাজমা (রক্তের তরল অংশ) লিকেজ হয়ে রোগী দ্রুত শকে চলে যেতে পারে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তা আরো ভয়ঙ্কর।
এবারের ডেঙ্গুতে তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি, র্যাশ দেখা যায়না, রক্তক্ষরণও হয়না। হাড়ে বা শরীরের সংযোগস্থলে ব্যথাও হয়না।ফলে অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত।তাই গুরুত্ব দেন না।
জ্বর চলে যাওয়ার পরে প্লাটিলেট ভেঙ্গে ব্লাডপ্রেসার কমে কলাপস করে। জ্বরের সাথে বমি ও লুজ মোশনও ডেঙ্গুর লক্ষণ।''ফলে এবার মৃত্যুর হার বেশি।
এবারের ডেঙ্গু হেমোরেজিক নয়, শকড সিনড্রম ।তাই পরামর্শ হলো অল্প বা বেশি যেকেনো মাত্রার জ্বর হলেই দ্রুত রেজিস্ট্যারড চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। অপেক্ষা করা চলবে না।
ডেঙ্গু মশাবাহিত রোগ। এডিস মশা থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যতটুকু সম্ভব গ্রহণ করুন। এক্ষেত্রে মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোর কোন বিকল্প নেই। বিকাল-সন্ধ্যার দিকে ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে দিন। মশানিরোধক এরোসল ব্যবহার করুন। ফুলের টব, কৌটা ইত্যাদি জায়গায় পানি জমে থাকলে সেগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলুন।
জরুরি বিষয়, জ্বর আসার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই নিকটস্থ হাসপাতাল অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে CBC (Complete Blood Count) এবং ডেঙ্গু NS1 antigen test করবেন। উল্লেখ্য যে, ডেঙ্গু NS1 Antigen সাধারণত জ্বরের প্রথম তিনদিন পর্যন্ত পজিটিভ রেজাল্ট শো করে। এরপরে করালে এই টেস্ট নেগেটিভ হয়ে যায়। তাই মনে রাখবেন, এবারের জ্বর কোন হেলাফেলার ব্যাপার নয়।
ডেঙ্গু NS1 test নেগেটিভ অথবা CBC রিপোর্টে স্বাভাবিক প্লেটলেট (১,৫০,০০০-৩,০০০০০) হলেই কিন্তু ডেঙ্গুর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। তীব্র জ্বর/ গা ব্যথা, চোখের পেছনদিকে ব্যথা, শরীরে চুলকানি বা র্যাশ, বমি, পেটে ব্যথা ইত্যাদি ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ। ডেঙ্গু NS1 নেগেটিভ হলেও প্রতিদিনের CBC রিপোর্টে ক্রমাগত প্লাটিলেট কাউন্ট কমতে থাকা এবং স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি Hematocrit level (স্বাভাবিক Hematocrit = হিমোগ্লোবিন লেভেলের তিন গুণ) ডেঙ্গুর ডায়াগনোসিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়।
ডেঙ্গু জ্বরের পঞ্চম-ষষ্ঠ দিনে জ্বরের মাত্রা কমে যায়, কিন্তু এই সময়টায় শারীরিক জটিলতা তৈরি হয় সবচেয়ে বেশি। দ্রুতহারে প্লাটিলেট কমে যাওয়া, দাঁতের মাড়ি অথবা মলমূত্রের সাথে রক্তক্ষরণ, রক্তনালী থেকে অতিরিক্ত প্লাজমা (রক্তের তরল অংশ) ক্ষরণ হয়ে দেহের অভ্যন্তরীন ফাঁকা অংশে ( ফুসফুসের পর্দার মাঝামাঝি/ পেটে) জমে যাওয়া, ব্রেইন, কিডনী অথবা হার্টের এর প্রদাহ - এগুলো ডেঙ্গু জ্বরের কারণে সৃষ্ট জটিলতা।
ডেঙ্গু NS1 negative হলে অথবা প্রথম তিনদিনের ভেতর করানো না গেলে, জ্বরের ষষ্ঠ দিন পেরোনোর পর কনফার্মেটরি টেস্ট হিসেবে Anti-ডেঙ্গু Antibody (IgM, IgG) test করাতে হবে। এসকল টেস্টেঃ
- IgM পজিটিভ মানে এবার ডেঙ্গু fever হয়েছে।
- IgM নেগেটিভ অথচ IgG পজিটিভের অর্থ - এবার ডেঙ্গু হয়নি, তবে আগে কখনও হয়েছিল। সেক্ষেত্রে অন্য কোন উপসর্গ না থাকলে অথবা স্বাভাবিক CBC থাকলে ডেঙ্গু হয়নি বলে ধরা যায়।
- তবে হ্যা, IgM নেগেটিভ হয়েও যদি, IgG level স্বাভাবিক মাত্রার চারগুণ বেশি হয়, তাহলে ডেঙ্গু positive ধরে নিতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। ব্যথার জন্য শুধুমাত্র প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনরকম পেইন কিলার ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী, যারা নিয়মিত aspirin/clopidogrel জাতীয় ওষুধ খান, ডেঙ্গু জ্বরের সময়ে তা বন্ধ থাকবে। একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট। প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে। তবে বাজারের জ্যুস এড়িয়ে চলবেন। ডেঙ্গু থাকা অবস্থায় পাতলা পায়খানা হলে তা জটিলতা অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। স্বাভাবিক মাত্রায় প্রস্রাব হচ্ছে কিনা, তার হিসাব রাখতে হবে। তিনবেলা ব্লাড প্রেশার মনিটর করা অতি মাত্রায় জরুরি।
প্রচলিত গুজব, পেপে পাতার রস খাওয়ালে প্লাটিলেট কাউন্ট বেড়ে যায়। এই ধারণার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কোন ওষুধ অথবা পথ্যের মাধ্যমে প্লাটিলেট কাউন্ট বাড়ানো যায় না। ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে রক্তের প্লাটিলেট ভেঙে যেতে থাকে এবং নির্দিষ্ট সময় পর আপনা-আপনিই তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। এছাড়াও উল্লেখ্য যে, ডেঙ্গুর চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক অথবা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের কোন ভূমিকা নেই।
ডেঙ্গু ধরা পড়লে প্রতিদিন CBC টেস্ট করাতে হবে। বারবার CBC টেস্ট এর মাধ্যমে হেমাটোক্রিট এবং প্লাটিলেট ভাঙ্গার রেট মনিটর করা হয়। আপনার ব্লাড গ্রুপ জানুন এবং সেই একই ব্লাড গ্রুপের পরিচিতদেরকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখুন। প্লাটিলেট কাউন্ট কমে ১৫ হাজারের নিচে নামলে সেফটি মিজার হিসেবে প্লাটিলেট ট্রান্সফিউজ করা হয়ে থাকে।
তবে হ্যা, প্লাটিলেট কমে যাওয়ার প্রবণতাকে প্রচলিত ধারণায় বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসা হলেও, সেটা আসল চিন্তার বিষয় নয়। Fluid management হচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ডেঙ্গু কনফার্ম হলে শারীরিক অসুবিধা থাকুক আর না থাকুক, দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ভালো সিদ্ধান্ত হবে। কারণ এবারের ডেঙ্গু অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে ভয়াবহ এবং দ্রুত জটিলতার সৃষ্টি করছে।
সবাই সাবধানে থাকুন। ডেঙ্গু জ্বর বিষয়ে নিজে জানুন এবং অন্যদের জানান।
References
Rafi, D. W. (2019). ডেঙ্গু ভাইরাস. Dhaka.