দিনকে দিন কাজের গতি এবং প্রতিযোগিতা দুটাই বেড়ে চলেছে এবং কাজের সাথে যুক্ত মানুষগুলোর মস্তিষ্কে পড়ছে মানসিক চাপ। এর জন্যে দেখা যায় অনেকেই মানসিক অবসাদে ভুগেন, হতাশ হয়ে পড়েন, চিন্তায় থাকেন এবং যে জিনিশটি সবচেয়ে বেশি শুনা যায় সেটি হচ্ছে প্যানিক অ্যাটাক। তবে প্যানিক অ্যাটাকের পাশাপাশি বা খুব কাছাকাছি আরেকটি মানসিক সমস্যা আছে সেটি হলো এনজাইটি অ্যাটাক। এই দুইটি শব্দ প্রায়শই একইভাবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এদের মধ্যে সাধারণ কিছু লক্ষণ থাকলেও এরা আসলে আলাদা দুটি সমস্যা। এদের সম্পর্কে সূক্ষ্ম ধারণা না থাকার ফলে অনেক মানুষ ভুল চিকিৎসার দিকেও পা বাড়ায় কিংবা বেশি চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।
প্যানিক অ্যাটাক কী এবং এর লক্ষণগুলোঃ
প্যানিক অ্যাটাক বলে কয়ে আসে না অর্থাৎ কোনো কিছু দেখে আপনার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে আর আপনার প্যানিক অ্যাটাক হবে ব্যাপারটি তা নয়। হঠাৎ করেই প্যানিক অ্যাটাক আসে প্রচণ্ড ভয় বা আতঙ্ক নিয়ে এবং এটি এনজাইটি অ্যাটাকের থেকে বেশি ভয়ানক হয়ে থাকে।
লক্ষণঃ
- কোনো আগাম বার্তা ছাড়া বা লক্ষণ প্রকাশ করা ছাড়াই হঠাৎ করে প্রচণ্ড ভয় মনকে গ্রাস করে ফেলে। পুরুষদের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে এটি বেশ হয়ে থাকে।
- খুব দ্রুত হৃদ স্পন্দন হতে থাকে। স্নায়বিক কিছু কারনে অ্যামিগডালা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই কারনে হৃদ স্পন্দন বৃদ্ধি পায়। অ্যামিগডাল হলো মস্তিষ্কের সেই অংশ যেটি আকস্মিক প্রতিক্রিয়া কিংবা ভয় এর প্রতিক্রিয়া দিয়ে থাকে। এ সময় অনেকে এমন অনুভব করে যে তার হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।
- বুকে ব্যাথা হয়। এই অনুভুতি ওই সময়ে হার্ট অ্যাটাকের সাথে মানুষ গুলিয়ে ফেলতে পারে। তবে সনাক্ত করার উপায় হচ্ছে প্যানিক অ্যাটাক হলে বুকের মাঝে ব্যাথা করে এবং হার্ট অ্যাটাক হলে বুকের বা পাশে ব্যাথা করে।
- হঠাৎ করে শরীর গরম হয়ে যায় অথবা ঠান্ডা হয়ে যায়। প্যানিক অ্যাটাক ৫-১০ মিনিট স্থায়ী হয় কিন্তু এই অনুভুতিটা প্রায় ঘন্টা খানেক থাকতে পারে।
- ঘাম আসে এবং শরীর কাপতে থাকে। এই সময় নিজেকে অনেক দুর্বল বলে অনুভব করে।
- শ্বাস কষ্ট হতে পারে। প্যানিক অ্যাটাক হলে শরীরে অক্সিজেন ঘাটতি দেখা যায়। তখন মানুষ দ্রুত শ্বাস নিতে থাকে কিন্তু মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যায়।
- এরকম অনুভব হতে থাকে যে সে মারা যাচ্ছে হয়তো। মানুষের অবচেতন মনের গভীর ভয় গুলো এই সময় মানুষের মনে হান দেয় যা তার মধ্যে মৃত্যুভয় গ্রাস করে।
- আরো অনুভব হতে পারে যে পাগল হয়ে যাচ্ছে এবং মানসিক নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছে। মস্তিষ্ক অসামাঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করে। মস্তিষ্কের অর্ধেক বলবে দৌড়াতে এবং বাকি অর্ধেক বলবে স্থির থাকতে।
এনজাইটি অ্যাটাক কী এবং এর লক্ষণগুলো
এনজাইটি অ্যাটাক, প্যানিক অ্যাটাকের থেকে বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন। এনজাইটি অ্যাটাকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এর পেছনে কোন উদ্দীপক থাকে। কোন উদ্দীপকের দরুন ব্যক্তি এই অ্যাটাকের সম্মুখীন হতে পারে। এছাড়াও এধরনের অ্যাটাকের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
লক্ষণঃ
- সহজেই ভয় পাওয়া বা চমকিয়ে ওঠা।
- বুকে ব্যথা অনুভব করা।
- মাথা ঘুরানো।
- অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া।
- মুখ শুষ্ক হওয়া।
- দ্রুত হৃদস্পন্দন হওয়া।
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
- পেশিতে ব্যথা অনুভব হওয়া।
- চিন্তিত বোধ করা।
- দম বন্ধ লাগা।
প্যানিক অ্যাটাক ও এনজাইটি অ্যাটাকের মধ্যে কিছু পার্থক্য জানা প্রয়োজন। এগুলো জেনে রাখলে আতংকগ্রস্থ না হয়ে সঠিক ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
১) প্যানিক অ্যাটাক কোনো আগাম বার্তা ছাড়া হুট করেই আসতে পারে কিন্তু অন্য দিকে এনজাইটি অ্যাটাক কোনো পরিস্থিতি কিংবা কোনো কিছু দেখে হতে পারে।
২) প্যানিক অ্যাটাক এর লক্ষণগুলো একটু আতংকজনক হয়ে থাকে যেমন- মারা যাচ্ছে এমন অনুভুতি আসে। অন্যদিকে এনজাইটি অ্যাটাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী কম বেশি প্রবলতা লক্ষ্য করা যায়।
৩) প্যানিক অ্যাটাক হঠাৎ করেই হয় নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। কিন্তু এনজাইটি অ্যাটাক আপনি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তত থাকলে ঘন ঘন হতে পারে।
৪) প্যানিক অ্যাটাক কয়েক মিনিটের জন্য হয়ে থাকে কিন্তু এনজাইটি অ্যাটাক বেশ সময় ধরেই হয়ে থাকে।
প্যানিক অ্যাটাক বা এনজাইটি অ্যাটাক হওয়ার পর কী করবেন?
- কী হচ্ছে সে ব্যাপারে ভালো মতন বুঝার চেষ্টা করতে হবে। মাথায় প্যানিক কিংবা এনজাইটি অ্যাটাক এর লক্ষণগুলো রাখতে হবে এবং বুঝতে হবে আপনার আসলে কোনটি হয়েছে। চিন্তা করতে থাকলে ভয় কেটে যাবে আস্তে আস্তে।
- আস্তে আস্তে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে হবে। এরকম অ্যাটাকে শ্বাস নেয়া কষ্ট হয়ে পড়ে তাই আস্তে আস্তে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে গভীরভাবে মনোযোগ দিয়ে রাখতে হবে। ১-৪ পর্যন্ত গুনুন প্রত্যেক শ্বাস নেয়ার সময়।
- শিথিলকরণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জেনে রাখতে হবে। অ্যাটাক হওয়ার পর এই শিথিলকরণ পদ্ধতি সাহায্য করবে। অনলাইনে অনেক ভিডিও-অডিও পাওয়া যায়।
- ম্যাডিটেশনের মাইন্ডফুলনেশ নিয়ে কাজ করতে পারেন। এনজাইটি অ্যাটাক যাদের হয় তাদের মন একাগ্র রাখার জন্যে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকরী।
প্যানিক অ্যাটাক এবং এনজাইটি অ্যাটাক থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়ঃ
১। দৈনিক ৮ ঘণ্টা ঘুমানো।
২। উদ্দিপকগুলো ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং এড়িয়ে চলা।
৩। মেডিটেশন, ইয়োগা প্রভৃতি করার চেষ্টা করা।
৪। রোজ ব্যায়াম করা।
৫। আনন্দের কিছু করার জন্য রোজ সময় বের করা।
৬। সাহায্য পাওয়া যায় এমন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ রাখা।
এগুলো মেনে চলার চেষ্টা করলে প্যানিক অ্যাটাক ও এনজাইটি অ্যাটাক থেকে রেহাই পাবো। আর কখনো অ্যাটাক হলেও আতঙ্কিত না হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করবো তাহলে নিজেদের মানসিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করতে পারবো। এগুল ছোট করে দেখার কোনো সমস্যা নয় সে বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে কেননা মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব মানুষের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্রঃ
১। https://www.medicalnewstoday.com/articles/321798.php
২। https://www.healthline.com/health/panic-attack-vs-anxiety-attack
৩। https://roar.media/bangla/health/know-about-panic-attack/