অনেক সময়ই আপনি বাসা থেকে বের হওয়ার
পর আবারও গিয়ে চেক করে আসেন যে আসলেই বাসায়
তালা দিয়েছেন কিনা কিংবা চুলাটি বন্ধ করেছেন কিনা। মাঝেমধ্যে এটা করা খুবই স্বাভাবিক
অভ্যাস এবং এটা আপনার সচেতনতারই বহিঃপ্রকাশ। তবে আপনি যদি শুচিবায়ু বা অবসেসিভ-কম্পালসিভ
ডিসঅর্ডার (ওসিডি) তে ভোগেন, তাহলে অনেক সময় ধরে বারবার একই কাজ করার মত আচরণগুলো এতটাই সর্বগ্রাসী হয় যে এগুলো আপনার দৈনন্দিন
জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। শুচিবায়ু রোগ হল উদ্বেগজনিত মানসিক ব্যাধি যা নিয়ন্ত্রণহীন,
অযাচিত চিন্তাভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক কাজকর্ম বা আচরণের সমষ্টি যা আপনি মনের অজান্তেই করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এক কথায় একই কাজ বারবার করাই হল শুচিবায়ুগ্রস্থতা।
এ রোগে সাধারণত অতিরিক্ত পরিষ্কার
পরিচ্ছন্নতা বা বারবার হাত ধোয়ার বাতিক থাকে, বারবার ফ্যানের সুইচ, দরজার লক, চুলা
ইত্যাদি বন্ধ করা হয়েছে কিনা তা বারংবার চেক করে, অতিরিক্ত সন্দেহ ও পাপের ভয় কাজ করে, নির্দিষ্ট নম্বর, রঙ সম্পর্কে কুসংস্কার থাকতে পারে, অপ্রয়োজনীয় বা
ফেলনা জিনিস জমানোর অভ্যাস থাকতে পারে।
শুচিবায়ুগ্রস্থতা মস্তিষ্ককে একটি বিশেষ
চিন্তাভাবনায় আটকে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি
চুলাটি সত্যই বন্ধ করেছেন কিনা তা নিশ্চিত করতে বারবার পরীক্ষা করে দেখতে থাকেন কারণ আপনি নিজের ঘর পুড়িয়ে
ফেলার ভয়ে অতিমাত্রায় ভীত থাকেন বা জীবাণুর ভয়ে বারবার হাত ধুয়েও মনে হয় হাতে ময়লা রয়েই গিয়েছে । ফলে মূল্যবান সময় নষ্টের পাশাপাশি
একজন রোগী সবসময়ই মানসিক উদ্বেগে ভুগতে থাকেন এবং সামাজিক ভাবে ও অনেক সময় হেয় প্রতিপন্ন
হন।
এ রোগের কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি।
তবে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
জৈবিক কারণ: দেহের রাসায়নিক বা মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপগুলির পরিবর্তনের
ফলাফলস্বরূপ এ রোগ হতে পারে।
জীনগত কারণ: জিনগত উপাদান দায়ী থাকতে পারে তবে বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট জিনগুলি
এখনও সনাক্ত করতে পারেনি।
পরিবেশগত কারণ: কিছু পরিবেশগত কারণেও এ রোগ হয়ে থাকে তবে এ জন্য আরও গবেষণার
প্রয়োজন
এই শুচিবায়ু রোগের দুইটি ধাপ, অবসেশন ও কমপালশন:
অবসেশন হল অনিচ্ছাকৃত চিন্তাধারা যা আপনার মনের মধ্যে বারে বারে আসে। আপনি
এই ধারণাগুলি রাখতে চান না তবে আপনি এগুলো থামাতেও পারেননা। দুর্ভাগ্যক্রমে, এ চিন্তাভাবনাগুলো
প্রায়শই নেতিবাচক, বিরক্তিকর এবং বিভ্রান্তিকর হয়।
কমপালশন হল এমন একটি অবস্থা যা আপনাকে কোনো কাজ বারবার সম্পাদন করতে পরিচালিত করে। এর ফলে আপনি একই কাজ বারবার করতে থাকেন। বাধ্যতামূলক
এই আচরণগুলো প্রায়শই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার সৃষ্টি এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে ওঠার কারণে
উদ্বেগ সৃষ্টি করে। শুচিবায়ু রোগের দুষ্টচক্র হলো -
অবসেশন➡উদ্বেগ➡কমপালশন➡সাময়িক প্রশান্তি➡
পুনরায় অবসেশন
লক্ষণসমূহ: শুচিবায়ুগ্রস্থতার লক্ষণগুলো সাধারণত অবসেসিভ চিন্তা ও কম্পালসিভ
আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যখন আপনার মধ্যে কোন বিষয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দেয় এবং
এই দুশ্চিন্তার ফলে আপনি একই কাজ বারবার করতে থাকে সেটাই হলো শুচিবায়ু রোগ।
সাধারণত অবসেসিভ চিন্তার লক্ষণগুলোর
মধ্যে রয়েছে:
● জীবাণু বা ময়লা দ্বারা দূষিত হওয়ার ভয় বা অন্যকে
দূষিত করার ভয়
● নেতিবাচক
চিন্তা, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর এবং
নিজের বা অন্যের ক্ষতি করার ভয়
● নেতিবাচক
যৌনচিন্তা বা হিংসাত্মক চিন্তাভাবনা
● ধর্মীয় বা নৈতিক ধারণাগুলিতে অতিরিক্ত ফোকাস
● প্রিয়
কোনো জিনিস হারানোর বা না পাওয়ার ভয়
● প্রতিটি
বস্তু ঠিকঠাক জায়গায় ও গুছানো আছে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ
● কুসংস্কারগ্রস্ত
এবং ভাগ্যবান বা দুর্ভাগ্যজনক কিছু বিবেচনার
জন্য অতিরিক্ত মনোযোগ
● সব
কাজেই পুরোপুরি পার্ফেক্ট হবার জন্য দুশ্চিন্তা করা
কম্পালসিভ
আচরণগুলোর মধ্যে রয়েছে
● লক,
সরঞ্জাম এবং সুইচের মতো জিনিসগুলো অতিরিক্ত মাত্রায় ডাবল-চেকিং
● প্রিয়জনদের
নিরাপত্তা নিয়ে অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তা করা এবং বারবার তাদের অবস্থা জানতে চাওয়া
● কোন
কিছু ধোঁয়া বা পরিষ্কার করতে অনেক বেশি সময় ব্যয় করা
● ঘর, কাপড় বা জিনিসপত্র বারবার গোছানো
● পুরানো সংবাদপত্র বা খালি খাবারের পাত্র যেমন
"জাঙ্ক" জমিয়ে রাখা
চিকিৎসা
শুচিবায়ু রোগের প্রধান দুটি চিকিৎসা
হ'ল সাইকোথেরাপি এবং ওষুধ। আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য এক ধরণের সাইকোথেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়রাল
থেরাপি বা সিবিটি থেরাপি সবচেয়ে কার্যকর চিকিত্সা
এবং এর সাধারণত দুটি উপাদান:
● এক্সপোজার
এবং প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ (ইআরপি), এক ধরণের সিবিটি থেরাপি যা ধীরে ধীরে কোনও ভয়যুক্ত
বস্তু বা আবেগের কাছে আপনাকে উন্মোচিত করে এবং
● আপনার
উদ্বেগ মোকাবেলার জন্য স্বাস্থ্যকর উপায়গুলি শিখতে সাহায্য করে। ইআরপি দীর্ঘ সময় ও প্রচেষ্টার চিকিৎসা , তবে একবার
আপনি যদি নিজের আবেগ এবং চিন্তাধারা পরিচালনা করতে শিখে যান তাহলে আপনি আরও ভালভাবে
জীবনকে উপভোগ করতে পারবেন।
অন্যান্য চিকিৎসা:
থেরাপি ছাড়াও শুচিবায়ু রোগের জন্য
নিম্নলিখিত চিকিৎসা ব্যবহৃত হয়:
ঔষধ:
কিছু ঔষধ এ মানসিক রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। প্রথমত রোগীকে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস দেওয়া হয়। কিছু অনুমোদিত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টসগুলির মধ্যে রয়েছে: ক্লোমিপ্রামাইন (আনফ্রানিল) দশ বছর বা তার বেশি
বয়সী বাচ্চাদের জন্য, সাত বছর বা তার বেশি বয়সী বাচ্চাদের জন্য ফ্লুওক্সেটিন (প্রোজাক), প্রাপ্তবয়স্কদের এবং আট বছর বা তার বেশি বয়সের
বাচ্চার জন্য ফ্লুভোক্সামিন, প্যারোক্সেটিন (প্যাক্সিল, পেক্সেভা) কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের
জন্য, প্রাপ্তবয়স্ক এবং ছয় বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী বাচ্চাদের জন্য সার্ট্রলাইন
(জোলফ্ট)।
তবে আপনার চিকিৎসক অন্যান্য এন্টিডিপ্রেসেন্টস
এবং মানসিক রোগের ওষুধ দিতে পারেন। কখনও কখনও এন্টিডিপ্রেসেন্টস থেরাপির সাথে একত্রে
ব্যবহৃত হয়। মস্তিষ্কের যে অংশ রোগীকে একই
কাজ বার বার করাচ্ছে ওষুধগুলি সেই অংশে ক্রিয়া করে এবং রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
পারিবারিক থেরাপি: যেহেতু শুচিবায়ু
রোগ প্রায়শই পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে
সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি করে, তাই পারিবারিক থেরাপি এই ব্যাধিটিকে বোঝার জন্য এবং
পারিবারিক দ্বন্দ্ব হ্রাস করতে সহায়তা করে।
এটি পরিবারের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করতে এবং তাদের প্রিয়জনকে কীভাবে সহায়তা করতে পারে তা শিখিয়ে দিতে পারে।
গ্রুপ থেরাপি: অন্য আক্রান্ত রোগীদের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে গ্রুপ থেরাপি
বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি হ্রাস করে এবং নিজের উপর আস্থা বাড়ায়।
প্রতিরোধ:
শুচিবায়ু একটি জটিল মানসিক রোগ হলেও
আপনি নিজেই কিন্তু অনেকাংশেই রোগটি প্রতিরোধ করতে পারেন। আপনি যদি এই রোগে আক্রান্ত
হন বা হওয়ার ভয় থাকে তাহলে আপনি আপনার জীবন যাপনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসুন আজই।
যেমন- নিয়মিত প্রার্থনা করুন, ব্যায়াম করুন, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান, সুষম এবং পুষ্টিকর
খাবার গ্রহণ করুন। আপনার মধ্যে যদি শুচিবায়ু রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় তাহলে তা নিঃসংকোচে
আপনার পরিবার কিংবা কোন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করুন।
মনে রাখবেন শুচিবায়ু রোগ চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয় তাই আজই দেরি না করে
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।