
আমাদের দেশে একজন গর্ভবতী নারী গর্ভাবস্থায় যতটুকু সেবা পান তার সবকিছুই অনেক কমে যায় বাচ্চা প্রসবের পরপরই। অজ্ঞতার কারণে একজন মায়ের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিয়ে কোন রকম বিকার দেখা যায়না অনেক সময় শিক্ষিত সমাজেও। যার ফলে নতুন শিশুটিকে নিয়ে সবার মাঝে যে উৎসাহ বিরাজ করে তার একদম উল্টোটিই ঘটে মায়ের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে গর্ভাবস্থা পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিতে অবহেলা ও অজ্ঞতাই মূল কারণ বলে মনে করা হয়।
শিশুর জন্মের পরপরই শুরু হয়ে যায় গর্ভ পরবর্তী অবস্থা এবং সাধারণত এর স্থায়ীত্ব ছয় থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত হয়ে থাকে (Anonymus, n.d.)| এসময় একজন নতুন মায়ের যে বিশেষ কিছু সেবা প্রয়োজন হয় চলুন তা সম্পর্কে জেনে নেই :
প্রসবোত্তর
সংক্রমণ: সাধারণত প্রসবজনিত সংক্রমণ ঘটে জরায়ু ও
এর চারদিকে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে। আর এ ব্যাকটেরিয়া
আক্রমণের মূল কারণ হল
স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। ফলে আক্রান্ত হতে
পারে প্রস্রাবের নালী, যোনীপথ এবং কিডনি। আর
গবেষণায় দেখা গেছে স্বাভাবিক
প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান প্রসবে এ সংক্রমণের হার
বেশী হয়ে থাকে। যেহেতু
আমাদের দেশে বর্তমানে সিজারিয়ান
প্রসবের সংখ্যাই বেশী, তাই আমাদের আরও
বেশী এ বিষয়ে জনসচেতনতা
প্রয়োজন। এ ধরনের সংক্রমনের
লক্ষণ হিসেবে জ্বর, মাথাব্যথা,
ক্ষুধামান্দ্য, তলপেটে ব্যথা সহ ত্বক ফ্যাকাশে
হয়ে যাওয়ার মত লক্ষণ দেখা
দেয়। তাই এসব লক্ষন
দেখা দিলে অতিসত্বর চিকিৎসকের
পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহন করতে হবে। (Anonymus, n.d.)
পেটের
সাদা দাগ: প্রসবের পর প্রায়ই পেটে
সাদা রঙের দাগ দেখা
যায়। বেশীরভাগ দাগই পেন্সিলের রেখার
ন্যায় সরু হয়ে যায়
দুই এক বছরের মধ্যেই,
তবুও কখনই পুরোপুরি চলে
যায় না। এজন্য চিকিৎসকের
পরামর্শ অনুযায়ী মেডার্মা নামক এক ধরনের
জেল ব্যবহার করা যায় যা
খুব দ্রুত এ দাগগুলোকে মিশিয়ে
ফেলতে সাহায্য করে। তাই প্রসবের
পরপরই দেরি না করে
চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে। অনেকেই
বেল্ট ব্যবহার করেন বা বিভিন্ন্
ভিটামিন-ই যুক্ত তেল ব্যবহার করেন
যার কোন যথার্থতা গবেষণায়
পাওয়া যায়নি
শারীরিক
সম্পর্কের বিধিনিষেধ: প্রসব পরবর্তী সময়ে ২-৪
সপ্তাহ পর্যন্ত শারীরিক সম্পর্ক হতে পুরোপুরি ভাবে
বিরত থাকা উচিত। কেননা
এতে করে অতিরিক্ত রক্তস্রাব
সহ প্রস্রাবের সংক্রমনের সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই
গর্ভাবস্থা পরবর্তী সময়ে প্রথমবার শারীরিক
সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বে নতুন মায়ের শারীরিক
সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। এছাড়া
অনেক নারীই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে অনিহা বোধ করেন। সেক্ষেত্রে
তার মানসিকতার প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
নিতে হবে।
বিষন্নতা:
গর্ভাবস্থা পরবর্তী সময়ে বিষন্নতা যদিও
খুবই প্রচলিত একটি স্বাস্থ্যসমস্যা, তবুও
খুব কম মানুষই এসম্পর্কে
জানে কিংবা সে অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা
গ্রহন করে। কিছু লক্ষণ
যেমন হতাশা, সামান্য কিছুতেই মেজাজ খারাপ করা, অযথা কান্নাকাটি
করা, মাথাব্যথা, খাবার গ্রহণে অনিয়ম, নিজেকে দোষী ভাবা, স্থায়ী
ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা , নতুন শিশুর প্রতি
আগ্রহের অভাব দেখা যায়।
এমনকি বিষন্নতা থেকে নিজের সন্তান হত্যা
কিংবা আত্মহত্যার মত ঘটনাও আমাদের
দেশে বিরল নয়। নারীরা
এ সমস্যাগুলো নিয়ে সাধারণত কথা
বলেনা এবং পরিবারের সদস্যরাও
অজ্ঞতার কারণে এ বিষয়গুলো খেয়াল
করেনা। তাই নতুন মায়ের
মধ্যে উপর্যুক্ত লক্ষন দেখামাত্রই অবহেলা
না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন
হতে হবে। এছাড়া পরিবারের
সদস্যদের যত্ন, আন্তরিকতা এবং বিশ্বস্ততার মাধ্যমে
এ রোগের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব
মেলাজমা
বা মেছতা: শতকরা সত্তর ভাগের ও বেশী নারীদের
মুখে মেছতা দেখা দেয় গর্ভাবস্থা
পরবর্তী সময়ে। এটি যেমন তাদের
সৌন্দর্যে ব্যঘাত ঘটায় , অন্যদিকে তাদের মনে হীনমন্যতাও তৈরী
করে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্রিম ব্যবহার করলে মাত্র কয়েক
সপ্তাহের মধ্যেই মেছতা সম্পূর্ণরুপে দূর করা সম্ভব
পেট
বড় হয়ে যাওয়া: প্রায় নয় মাস একটি
শিশুকে পেটে ধারণ করার
ফলে পেট বড় হয়ে
যাওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা।
এ সমস্যায় অনেকেই বেল্ট ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে
থাকে যা আসলে ভুল
প্রমাণিত হয়েছে। এখন আবার অনেকে
বৈদ্যুতিক বেল্ট ব্যবহার করেন যা কেবল
কষ্টই বাড়িয়ে দেয়। আসলে অনেকের
চিকিৎসা ছাড়াই পূবের অবস্থায় ফেরত আসলেও অনেকেরই
চিকিৎসকের পরামর্শমত ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়ামের
প্রয়োজন হয়। ব্যায়ামের ফলে
শুধু পেটই নয় , পুরো
শরীরের পেশীই ধীরে ধীরে শক্ত
হতে থাকে
পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব: অনেক নতুন মা প্রসবের পর তার নবজাতকের যতœ নিতে গিয়ে নিজের সুস্থতার কথা ভুলে যান । ফলে গর্ভাবস্থায় সে যে পরিমাণ খাবার গ্রহণ করত তা অনেকটাই কমে আসে গর্ভাবস্থা পরবর্তী সময়ে। এতে পুষ্টির অভাবে ভুগে নানা অসুখ ও হরমোনের ভারসাম্যহীনতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এ সমস্যা দূরীকরণে পর্যাপ্ত খাবার গ্রহণের পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন ঔষধ ও গ্রহণ করতে হতে পারে (Anonymus, n.d.।
আসলে একজন মায়ের সুস্থতার উপরই নির্ভর করে নবজাতকের সুস্থতা। এছাড়া প্রসবের পর প্রসবজনিত জটিলতায় শিশু ও মাতৃমৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে প্রচুর। তাই গর্ভাবস্থা পরবর্তী মায়ের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবেনা। তাই্ নিজে সচেতন হোন এবং আপনার চারপাশের সকলকে সচেতন করুন।