
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান ভাবে দক্ষতার সাথে তাল মিলিয়ে চলা নারী যখন নিজের শরীরের ভেতরের ক্রিয়া-বিক্রিয়া নিয়ে ভারসাম্যহীনতায় ভোগে তখনই সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে জটিল এক রোগের জালে যার নাম হল পলিসিসটিক ওভারি। এটি আসলে কোন একক রোগ নয়, বরং অনেকগুলো রোগ এবং এগুলোর লক্ষণের সমষ্টি, যা সরাসরি একজন নারীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ডিম্বাশয়, জরায়ু ইত্যাদিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। আর এ লক্ষণগুলো যখন একত্রে দেখা দেয় তখনই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় পলিসিসটিক ওভারি সিনড্রোম বা পলিসিসটিক ওভারিআন সিনড্রোম বা সংক্ষেপে PCOS (Khanam and Parvin, 2014)।
প্রজননক্ষম নারীদের প্রায় ৬-১০% ই আক্রান্ত PCOS দ্বারা তাই বিষয়টি বর্তমানে মোটেও আর অবহেলার নয় (Hasanat, 2018) ।
কিভাবে বুঝবেন আপনি আক্রান্ত কিনা:
খুব প্রচলিত কিছু বাহ্যিক লক্ষণ যেমন মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘন লোম, ব্রণ, অনিয়মিত পিরিয়ড, মাথার চুল অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া, হঠাৎই ওজন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয় যে আপনার হয়তোবা পলিসিসটিক ওভারি রোগ আছে (Khanam and Parvin, 2014)।
তবে তিনটি বৈশিষ্ট্য দেখেই কেবল নিশ্চিত হওয়া সম্ভব আসলেই আপনি এ রোগে আক্রান্ত কিনা।
অনিয়মিত পিরিয়ড এর সমস্যা, রক্তে পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন বেড়ে যাওয়া এবং জরায়ু অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যাওয়া (ডিম্বাশয়ে সিস্ট তৈরী হওয়ার কারণে)- এ তিনটির যেকোন দুটি লক্ষণ ও যদি আপনার ভেতরে পাওয়া যায় তাহলেই এটা পুরোপুরি নিশ্চিত যে আপনি আসলেও পলিসিসটিক ওভারি সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত (NHS website, 2017) । তাই প্রাথমিক পর্যায়ে সন্দেহ হলেই এবং অনিয়মিত পিরিওডের সমস্যায় ভুগলেই আপনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে করিয়ে ফেলতে পারেন রক্তে অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের আধিক্য আছে কিনা কিংবা আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে জেনে নিতে পারেন ডিম্বাশয়ে কোন সিস্ট আছে কিনা (NHS website, 2017) ।
PCOS এর কারণে আর যেসব শারীরিক জটিলতার সম্মুখীন হবেন আপনি:
এ রোগের কারণে নারীরা নানারকম জটিলতায় ভুগে থাকেন। বর্তমানে নারীদের বন্ধ্যাত্ব ব্যাপক হারে বেড়ে যাবার অন্যতম কারণ হলো এ রোগ। এছাড়াও নারীদের আরও কিছু মারাত্বক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, জরায়ুর ক্যান্সার, রক্তে খারাপ কোলেস্টেরোল বৃদ্ধি পাওয়া, স্লিপ এপনিয়া (ঘুমের সোময় শ্বাস- প্রশ্বাস এর সমস্যা), ক্লান্তি ও বিষন্নতা বেড়ে যাওয়া সহ প্রভৃতি জটিলতা দেখা দেয় (Womens health, 2019)। তাই সময় এখনই সচেতন হবার।
কারণগুলো কী কী:
যদিও এ রোগের নির্দিষ্ট কারণ আজও অজানা, তবে গবেষকদের মতে নারীদেহে কিছু হরমোনের (যেমন: অ্যান্ড্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, ইনসুলিন) ভারসাম্যহীনতা কিংবা বংশগতকারণে এ রোগ হতে পারে। হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য সাধারণত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, অতিরিক্ত ওজন এবং শ্রমবিমুখতাকেই দায়ী করা হয় (Womens health, 2019)।
প্রতিকার করবেন কিভাবে:
যদি এখনো আপনার মধ্যে PCOS এর কোন লক্ষণ দেখা না দেয় তাহলে সৃষ্টিকর্তাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিন। আর যদি আক্রান্ত হয়েই যান তাহলেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কেননা দুশ্চিন্তায় বেড়ে যেতে পারে আরও কিছু ক্ষতিকর হরমোনের নিঃসরণ। যেহেতু কোন নির্দিষ্ট একটি কারণে এ রোগে আপনি আক্রান্ত হননি তাই শুধু ঔষধ খেলেই আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন তা ভাবলে আবারও চরম ভুল করবেন। চিকিৎসক হয়তো আপনার হরমোনের সামঞ্জস্যতা রক্ষার জন্য কিছু ঔষধের পরামর্শ দেবেন এবং তা সাময়িকভাবে আপনার লক্ষণগুলোকে দমন করে আপনাকে আরাম দেবে। আসলে এ রোগ পুরোপুরি সারানো কোনভাবেই সম্ভব নয় (NHS website, 2017; Womens health, 2019) । অথচ এসব ঔষধের সাইড ইফেক্টের কারণে আপনার শরীরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেখা দিতে পারে।
তাই আজ এ মূহুর্ত থেকেই আপনার জীবনের কিছু অভ্যাস পালটে ফেলুন।
- অভ্যাস করুন তাজা খাবার গ্রহণের। আজ থেকেই বাদ দিন বাজারের যেকোন প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য যেগুলো সাধারণত প্যাকেটজাত বা হিমায়িত (ফ্রোজেন) অবস্থায় পাওয়া যায়।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে শাক-সবজি ও ফলমূল গ্রহণ করুন।
- সেই সাথে ত্যাগ করুন ফাস্টফুড খাবারের প্রতি আসক্তি।
- প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান এবং অবশ্যই তা রাতে।
- আর প্রতিদিন অন্তত পনেরো মিনিট করে হলেও শরীরচর্চা করুন। বাংলাদেশের নারীরা সাধারণত শরীরচর্চার কথা শুনলেই ভয় পান। যারা ভাবেন ভারী কোন কাজ করতে হবে কিংবা অনেক সরঞ্জাম প্রয়োজন হবে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি শুধু হাঁটুন। নিয়মিত হাঁটা আপনার দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করবে। পর্যাপ্ত পরিশ্রম করুন। অন্তত নিজের ঘরের ছোটোখাটো কাজ গুলো তো নিজেই করতে পারেন (NHS website, 2017) ।
এভাবে আপনার একটু সচেতনতা, সতর্কতা এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনই পারে এ ঘাতক রোগ থেকে আপনাকে দুরে রাখতে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের উপায় জানুন, নিজে সচেতন হোন আর আপনার চারপাশের সবাইকে সচেতন করুন। ক্ষুদ্র এ জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত উপভোগ করুন কেননা নীরোগ দেহই তো সুখী মনের উৎস।
তথ্যসূত্র:
Hasanat, M. A. (2018). Polycystic Ovarian Syndrome-Studies in BSMMU, Bangladesh. Journal of Clinical and Molecular Endocrinology, 3, 2572-5432. doi:10.21767/2572-5432-C1-001
Khanam, K. & Parvin, M. (2014). An Observational Study on 100 Patients with Polycystic Ovarian Syndrome (PCOS). Journal of Enam Medical College, 4 (3):156-160
NHS website. (2017). Polycystic ovary syndrome. National Health Service (NHS). UK: Department of Health. Retrieved from https://www.nhs.uk/conditions/polycystic-ovary-syndrome-pcos/
Womens health. (2019). Polycystic ovary syndrome | Womenshealth.gov. Washington, DC: U.S. Department of Health and Human Services. Retrieved from https://www.womenshealth.gov/a-z-topics/polycystic-ovary-syndrome