
বাংলাদেশে ২০৩৫ সালের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১২৩ মিলিয়নে! নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তনে এ সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত জনসংখ্যার অর্ধেকই এখনও জানেন না তারা আদৌ এ রোগে আক্রান্ত কিনা। সেই সাথে রয়েছে এ রোগ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব এবং সমাজে প্রচলিত অসংখ্য ভুল ধারণা। ফলে জনসংখ্যার বিপুল অংশ রয়েছে মারাত্বক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। আর তাই আজ আমি আপনাদের সাথে ডায়াবেটিসের এমনই কিছু ভুল ধারণা নিয়ে আলোচনা করব ।
টাইপ ১ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ে যত অজ্ঞতা:
ডায়াবেটিস নিয়ে পরিপূর্ণ ধারণা আমাদের অনেকের মাঝেই নেই। আসলে ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা দুইটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। টাইপ ১ ডায়াবেটিস হয় যখন আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন হরমোন তৈরী হয় না। এই ইনসুলিন হল এমন একটি হরমোন যা আমাদের রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রন করে। অন্যদিকে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আমাদের শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপন্ন করতে সক্ষম হলেও তা কার্যকর উপায়ে ব্যবহার করতে পারেনা। ফলে উভয়ক্ষেত্রেই দেহের শর্করা ভেঙে শক্তি উৎপন্ন হয় না এবং অতিরিক্ত শর্করা রক্তে জমা হয় ও রক্তনালী দ্বারা বাহিত হয়ে প্রশ্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। একারণেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ঘন ঘন প্রশ্রাব হয়। অনেকেই ধারণা করেন টাইপ ১ ডায়াবেটিস কেবলমাত্র অল্পবয়সীদেরই হয় আর টাইপ ২ বয়স্কদের। কিন্তু বর্তমানে এ দুই ধরণের ডায়াবেটিস দ্বারা যে কোন বয়সী মানুষই আক্রান্ত হতে পারেন। আবার অনেকেই মনে করেন টাইপ ২ ডায়াবেটিসে কখনই ইনসুলিন গ্রহনের প্রয়োজন হয়না যেমনটি প্রয়োজন টাইপ ১ এ। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে কখনও কখনও টাইপ ২ ডায়াবেটিসেও ইনসুলিনের প্রয়োজন হতে পারে। তাই সঠিক ভাবে রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই কেবল ডায়াবেটিসের চিকিৎসা সম্ভব।
প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়াই ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ:
ডায়াবেটিস রোগটির প্রধান কারণ হিসেবে মিষ্টি জাতীয় খাবারকে দায়ী করাই এক নম্বর ভুল অথচ এ রোগের সাথে মিষ্টি খাবারের কোন সম্পর্কই নেই। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের কোন নির্দিষ্ট কারণ এখনও পর্যন্ত জানা না গেলেও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য তিনটি বিষয়কে দায়ী করা যায়।
1. বংশগত কারণে হতে পারে,
2. পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং
3. স্থুলতা
সুতরাং আপনি মিষ্টি খাবার কমিয়ে দিয়ে যদি প্রচুর পরিমাণে শর্করাজাতীয় খাবার গ্রহণ করেন তবে তা মোটেও নিরাপদ নয়। বরং আপনাকে অবশ্যই একটি নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে হবে আর একেবারে মিষ্টি খাবার বর্জন করার ও কোন প্রয়োজন হবে না। তাই ডায়াবেটিস রোগী মানেই কঠিন জিরো সুগারের ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা নয়। এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অন্য কারও ডায়েট ও অনুসরণ কখনই নয়।
রোগা মানুষের ডায়াবেটিস হয় না: অনেকেই তার রোগা শরীর নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন এই ভেবে যে তার হয়তো ডায়াবেটিসের আশংকা নেই। আদতে তা নাও হতে পারে। যদি আপনার বংশে কারও ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকে তাহলে অবশ্যই আপনার উচিত রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়মিত পরীক্ষা করা। গবেষণায় দেখা গেছে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা স্থুল মানুষের তুলনায় রোগা মানুষেই বেশী। অনেক ক্ষেত্রেই রোগা মানষেরা জানেনই না যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাই আপনি রোগা হোন আর স্থুল, বয়স পঁয়তাল্লিশ এর পর নিয়মিত ভাবে আপনার রক্তে শর্করার পরিমাণ পরীক্ষা করুন।
ডায়াবেটিস একটি অপ্রতিরোধ্য রোগ:
চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রি-ডায়াবেটিস নামে একটি শব্দ আছে যা আমাদের অনেকেরই অজানা। এটিকে বলা যায় আপনার জন্য একটি সতর্ক সংকেত। কেননা রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী হলেও তা ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত মাত্রায় নাও থাকতে পারে। আর রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশী হওয়া মাত্রই আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন। অর্থ্যাৎ এখানেই আপনার লাগামহীন জীবনযাপনের রাশ টেনে ধরার সময় এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে আপনিও প্রতিরোধ করতে পারেন এ মরণঘাতী রোগটি। দেখা যায় শতকরা নব্বই ভাগ লোকই এ বিষয়টি জানেননা যে সামান্য রক্ত পরীক্ষাই আপনাকে জানিয়ে দিতে পারে যে আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন কিনা। আর প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম নয় কি!
ডায়াবেটিস থাকলে গর্ভধারণ ঝুঁকিপূর্ণ:
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে অনেকেই গর্ভধারণে ভয় পান। একসময় যখন চিকিৎসাব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না, ডায়াবেটিস রোগটি নিয়ন্ত্রণের এত উপায় জানা ছিল না, তখন এটি সত্যিই ভয়ের কারণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া স্বত্তে¡ও খুব স্বাভাবিক এবং সুস্থ ভাবেই সন্তান জন্মদানে সক্ষম। তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে গর্ভধারণে বাঁধা নেই আর। এছাড়া অনেকের পূর্বে রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলেও গর্ভাবস্থায় হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। এতে অনেকেই আতঙ্কিত হন। এটি আসলে গেসটেশনাল বা গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস যা গর্ভপরবর্তী অবস্থায় আর নাও থাকতে পারে এবং আপনার রক্তে শর্করার পরিমাণ আবার ও স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। আাবার অনেকের গর্ভাবস্থার এ ডায়াবেটিস পরবর্তীতেও স্থায়ী হয় যা চিকিৎসকের পরামর্শ ও সঠিক জীবনযাপনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
ডায়াবেটিস কি সংক্রামক?:
এধরনের কোন প্রমাণ আসলে আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ডায়াবেটিস আসলে বংশগত বা পরিবেশের কারণে হতে পারে কিন্তু সংক্রামক কখনই নয়।
সুতরাং সঠিক তথ্য জানার মাধ্যমে রোগকে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করুন । রোগের ভয়কে জয় করুন এবং খুব দেরী হয়ে যাবার পূর্বেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন ।
তথ্যসূত্র:
Alyssa Jung, D. M. (n.d.). 20 Diabetes Myths That Could Be Sabotaging Your Health. Reader's Digest. Retrieved from https://www.rd.com/health/conditions/diabetes-myths/
Sheikh Mohammed Shariful Islam, A. L. (2017). Healthcare use and expenditure for diabetes in Bangladesh. BMJ Global Health.
World Health Organization. (2018). Diabetes. Retrieved from https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/diabetes