
কোভিড-১৯ মোকাবেলা করতে প্রতিনিয়ত গবেষকরা যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভ্যাক্সিন তৈরি জন্যে মানুষের দেহে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে এবং এই বিষয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে। এরই মধ্যে পুরোনো কিছু পদ্ধতিও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ব্যবহার করছেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের বাঁচানোর জন্যে। এগুলো সবই পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে, করোনা চিকিৎসার জন্যে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এই পরীক্ষামূলক চিকিৎসা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, এই চিকিৎসাপদ্ধতিগুলো নিরাপদ কী না। বর্তমানে এমনি একটি চিকিৎসা বেশ আলোচিত তা হলো- কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপি। এই ব্লগে প্লাজমা থেরাপির সম্পর্কে কিছু ধারণা এবং এই থেরাপিতে ঝুঁকি আছে নাকি তা উপস্থাপন করা হবে।
প্লাজমা থেরাপি কী?
মানবদেহের রক্তের জলীয় হলুদাভ অংশ হচ্ছে ৫৫ ভাগ যাকে প্লাজমা বা রক্তরস বলা হয়। একজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন সুস্থ হয়ে ওঠেন, তখন তাঁর রক্তে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার জন্য এন্টিবডি তৈরি হয়। প্লাজমা থেরাপিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন গুরুতর অবস্থায় থাকে তখন তাদের দেহে পরীক্ষামূলকভাবে করোনা ভাইরাস জয়ী ব্যক্তির রক্তের প্লাজমা দেয়া হয়। বিবিসে-কে সাক্ষাৎকার দেয়া ডা এম এ খান বলেন, 'প্লাজমায় অনেক ধরণের অ্যান্টিবডি থাকে। যখন কেউ কোন রোগে আক্রান্ত হন, তখন সেই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া বিরুদ্ধে এ ধরণের অ্যান্টিবডি প্রোটিন তৈরি হয়। ওই প্রোটিন জীবাণুর চারপাশে এক ধরনের আবরণ তৈরি করে সেটাকে অকেজো করে ফেলে। এভাবেই অ্যান্টিবডি কাজ করে।''
কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপি একটি পুরোনো চিকিৎসাপদ্ধতি। ১৯১৮ তে স্পানিশ ফ্লু এর চিকিৎসায় এবং ১৯৩০ সালে হামের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্ববর্তী করোনা ভাইরাস (সার্স) আক্রমণের সময় ২০০৩ সালে থেরাপি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সর্বপ্রথম এই পদ্ধতির আবিষ্কার করেন এবং নোবেল জয়ী এমিল ভন বেরিং। তিনি ডিপথেরিয়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
প্লাজমা থেরাপির কার্যকারিতা
যদি প্রশ্ন করা হয় যে প্লাজমা থেরাপি শতভাগ কার্যকরী কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি কি না তাহলে এর উত্তরে বলতে হবে না শতভাগ কার্যকরী এভাবে বলা যাবে না। এটি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এও গবেষক দল এর কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি অন্য অনেক হাসপাতালে এই পদ্ধতির পরীক্ষা করার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার এই পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য অনুমতিও দিয়েছে। ইবোলা ভাইরাসের চিকিৎসার জন্যেও ২০১৩-১৬ সালে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রথম দেশ চীনেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে ৪০-৮০ ভাগ কেইসের ক্ষেত্রে সফলতা দেখা যায়। অর্থাৎ সবসময় যে সফল কিংবা বিফল কোনটি হচ্ছে না। তবে এই চিকিৎসায় যে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে সেটি স্বীকার করতেই হবে।
যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জনমনে বেশি আসতে পারে তা হলো এই প্লাজমা থেরাপি পদ্ধতিতে প্লাজমা দেয়ার ক্ষেত্রে বা গ্রহণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ঝুঁকি আছে কি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পরীক্ষামূলক পদ্ধতি নেয়ার একটি নিরাপদ নিয়ম অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়ে অনুমোদন দিয়েছে। আমেরিকা সহ বিশ্বের অনেক দেশে সৌদি আরব, ভারত, চীন, মালয়শিয়ায় এই পরীক্ষামূলক পদ্ধতিটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ব্লগের পাঠকদের এটি বলেই আশ্বস্ত করতে চাই যে এই প্লাজমা দেয়া কিংবা নেয়ার ব্যাপারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিংবা স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। ডা দিলদার হোসেন একজন করোনাজয়ী, তিনি প্লাজমা থেরাপির জন্যে নিজের প্লাজমা ডোনেট করেছেন। তিনি বলেন, “আমি একজন নিয়মিত রক্তদাতা৷ এ পর্যন্ত ২৫ বারের মত রক্ত দিয়েছি৷ এটা রক্তদানের চেয়েও সহজ৷ ৩০-৩৫ মিনিট লেগেছে আমার৷ যারা করোনা পজিটিভ হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন তারা যদি প্লাজমা দেয়ার ব্যাপারে এগিয়ে আসেন তাহলে অনেকের জীবন বাঁচবে৷” হাসপাতালে যাদের অবস্থা খুব সংকট পর্যায়ে চলে যায় বা ভেন্টিলেশনে থাকেন তাদের সাধারনত ২০০ মিলি প্লাজমা দেয়া হয়ে থাকে। প্রায় একশ বছরের পুরনো এই পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো বড় কোনো ঝুঁকি লক্ষ্য করা যায়নি। তাই বাংলাদেশের চিকিৎসকরা আহ্বান করেছেন এই পদ্ধতির ওপর ভরসা রাখতে। যেহেতু এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি তাই শত বছরের পুরোনো এই পদ্ধতি ব্যবহারের প্রতি আস্থা রাখার কথা বলছেন চিকিৎসকরা।
প্লাজমা থেরাপির জন্যে এন্টিবডি পরীক্ষা করার জন্যে একটি বিশেষ রিএজেন্ট ব্যবহার করা হয় সেগুলো বাংলাদেশে সল্পতা রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা স্পেন থেকে সেটি নিয়ে আসছে কাজ করার জন্যে। প্লাজমা থেরাপির ক্ষেত্রে অনেক সময় ধারনা করা হয় যে যার প্লাজমা দেয়া হচ্ছে সেটি রোগীর শরীরে কার্যকরী না হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে তাঁর নিজ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে। তবে এই ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব এন্টিবডি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। প্লাজমায় কোনো ইনফেকশনের ঝুঁকি আছে কিনা, এইভআইভি ভাইরাস, হেপাটাইটিস বি, সি, ই ইত্যাদি পরীক্ষা কর নেয়া হয় এরপর রোগীর শরীরে দেয়া হয়। অর্থাৎ চিকিৎসকরা সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো মাথায় রেখেই পরীক্ষা করেই রোগীর শরীরে দিয়ে থাকেন।
প্লাজমা থেরাপির ব্যাপারে চিকিৎসকরা মানুষের সহযোগিতা কামনা করেছেন। যারা সুস্থ হয়ে বাসায় গিয়েছেন তাদেরকে প্লাজমা সংগ্রহ করার ব্যাপারে সাহায্য করতে বলেছেন। প্লাজমা দেওয়া বা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে তেমন ঝুঁকি নেই সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত হতে বলেছেন গবেষকরা। এই মুহূর্তে যেহেতু করোনা মোকাবেলা করা আমাদের জন্য খুব জরুরী সে জন্যে প্লাজমা থেরাপির ব্যাপারে সাধারণ মানুষ সহযোগিতা করলে এই পরীক্ষামূলক কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশে প্লাজমা নিয়ে গবেষণারত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তাই এই চিকিৎসার ব্যাপারে আপনারাও সচেতন হউন এবং অন্যদেরকেও জানাতে সাহায্য করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১। https://theconversation.com/coronavirus-what-is-plasma-therapy-137813
২। https://www.bbc.com/bengali/news-52687908