হরমোনকে বলা হয় মানবদেহের রাসায়নিক বার্তাবাহক যা শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। সাধারণভাবে আমাদের দেহের ভিতরে প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় হরমোন উৎপন্ন হয়। কিন্তু আধুনিকালের দ্রুতগতির জীবন ধারায় হরমোনের ভারসাম্যহীনতাগুলি ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠেছে। তবে আশার কথা এই যে, প্রাকৃতিকভাবে শুধুমাত্র আপনার জীবনযাপনের ধরণে পরিবর্তন এনেই আপনি আপনার হরমোনের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারেন । সেরকমই কিছু উপায় আজ আমরা জানবো
পর্যাপ্ত পরিমানে প্রোটিন গ্রহণ করুন
পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । প্রোটিন অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড সরবরাহ করে যা আপনার শরীর নিজে তৈরি করতে পারে না এবং পেশী, হাড় এবং ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে যা নিয়মিত গ্রহণ করা উচিত উপরন্তু, প্রোটিন ক্ষুধা এবং খাদ্য গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করে এমন হরমোনকে প্রভাবিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে পর্যাপ্ত প্রোটিন ক্ষুধা উদ্রেককারী হরমোন গেরিলিনের মাত্রা হ্রাস করে এবং তা হরমোন উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে। একারণে বিশেষজ্ঞরা প্রতিবার খাবার গ্রহণের সময় ২০-৩০ গ্রাম প্রোটিন খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিছু উচ্চ প্রোটিনসম্মৃদ্ধ খাবার যেমন - ডিম, বাদাম, সয়াবিন, ডাল, মাছ , মাংস আপনার খাবারে তাই থাকুক প্রতি বেলাতেই।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
নিয়মিত ব্যায়াম আপনার হরমোন নিয়ন্ত্রন করতে পারে। ব্যায়ামের একটি প্রধান সুবিধা হলো এটা ইনসুলিন মাত্রা হ্রাস এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে পারে। ইনসুলিন এমন একটি হরমোন যা রক্তের প্রবাহ থেকে শর্করা এবং অ্যামিনো অ্যাসিড গ্রহণ করতে কোষকে অনুমতি দেয়। তবে উচ্চ ইনসুলিন প্রদাহ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। হাঁটা বা অন্যান্য শারীরিক ব্যায়াম হরমোনের মাত্রাকে এমনভাবে সংশোধন করতে পারে যা রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে এবং বয়স বৃদ্ধির সময় পেশীর ভরকে রক্ষা করে।
চিনি বা পরিশোধিত শর্করা পরিহার করুন
চিনি এবং পরিশোধিত শর্করা স্বাস্থ্য সমস্যার একটি বড় কারণ। প্রকৃতপক্ষে, এই খাবারগুলি এড়ানো বা কমানোর ফলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য রোগগুলি এড়ানো যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ফ্রুকটোজ ইনসুলিনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে । চিনি এবং পরিশোধিত শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণে নিয়ন্ত্রন আপনার ইনসুলিন মাত্রা হ্রাস করবে এবং বিভিন্ন্ হরমোনের অসামঞ্জস্যতাজনিত রোগ যেমন ডায়াবেটিস, পলিসিসটিক ওভারি প্রভৃতি রোগ থেকেও আপনাকে দূরে রাখবে।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রন করতে শিখুন
মানসিক চাপ আপনার দেহে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলতে পারে । এটা দ্বারা প্রভাবিত দুটি প্রধান হরমোন কর্টিসোল এবং অ্যাড্রেনালাইন । কর্টিসোল "স্ট্রেস হরমোন" হিসাবে পরিচিত কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদী চাপে আপনার শরীরকে চাপের সাথে মোকাবিলা করতে সহায়তা করে । আর অ্যাড্রেনালাইন হল "যুদ্ধ-বা-ফ্লাইট" হরমোন যা অবিলম্বে বিপদকে জবাব দিতে আপনার শক্তি সরবরাহ করে। উচ্চতর অ্যাড্রেনালাইন মাত্রা উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি করতে পারে। তাই কারণ যাইহোক নিজের মন মেজাজকে শান্ত রাখুন নিজের ভালোর জন্যই।
অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের অভ্যাস পরিত্যাগ করুন
খুব বেশী বা খুব সামান্য খাবার খাওয়া ওজন সমস্যার কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ অত্যধিক পরিমাণে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়ানো এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা হ্রাস করে। বিশেষত অতিরিক্ত ওজনের এবং স্থূল মানুষ যারা ইনসুলিন প্রতিরোধী। অন্যদিকে, বেশি পরিমানে ক্যালোরি গ্রহণে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসোলের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে। যা ওজন বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই আপনার নিজের ব্যক্তিগত ক্যালোরি পরিসীমার মধ্যে খাওয়া আপনার হরমোেনর ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।
গ্রীন টি পান করুন
গ্রীন টি একটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত পানীয়। এতে উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য পরিচিত । বেশিরভাগ গবেষণায় পাওয়া গেছে যে গ্রীন টি ইনসুলিন প্রতিক্রিয়াতে উন্নতি করতে পারে, আপনি প্রতিদিন এক কাপ পান করতে পারেন। তাই যাদের ইনসুলিনের মাত্রা বেশি তাদের জন্য গ্রীন টি খুবই কার্যকর।
নিয়মিত পরিমিত ঘুমান
আপনি যতই পুষ্টিকর ডায়েট অনুসরণ করুন আর ব্যায়াম করুন না কেন , যদি যথেষ্ট পরিমাণে না ঘুমান তবে আপনার স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কম ঘুমকে ইনসুলিন, করটিসোল, লেপটিন, ঘেরলিন বৃদ্ধিসহ অনেক হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা রয়েছে । এছাড়া পুরুষদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতি সপ্তাহে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমায়, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা গড়ে ২০% হ্রাস পায়। অপর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজনীয় হরমোন হ্রাস, ক্ষুধা এবং স্ট্রেস হরমোন বৃদ্ধি, বৃদ্ধি হরমোন হ্রাস এবং ইনসুলিন প্রতিরোধের কারণ হতে পারে। তাই প্রাকৃতিকভাবে সর্বোত্তম হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে, প্রতিদিন রাতে কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘন্টা করে ঘুমানো উচিত।
নিয়মিত ডিম খান
ডিম অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং আপনার ক্ষুধা দমন করতে সাহায্য করতে পারে। এক গবেষণায়, পুরুষদের সকালের নাস্তায় ডিম খাওয়ায় ইনসুলিন হরমোনের মাত্রা কমতে দেখা যায়। তাই সকালের নাস্তায় একটি ডিম আপনার সারাদিনের কর্মক্ষমতার জন্য উপযোগী হতে পারে। এছাড়া আপনার ক্ষুধা কমিয়ে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ হতেও বিরত রাখবে।
বাজারের কোমল পানীয় থেকে দূরে থাকুন
চিনি বা তরল শর্করা বরাবরই হরমোনের সামঞ্জস্যতা রক্ষার জন্য ক্ষতিকর। এক গবেষণায় দেখা গেছে , যখন এধরণের পানীয়গুলি ওজন বেশি এমন মানুষদের খাওয়ানো হয় তখন তাদের রক্তের উচ্চ ইনসুলিনের মাত্রা, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা হ্রাস এবং পেটে মেদ সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাই আপনার হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চিনি বা মিষ্টি পানীয়গুলি একেবারে এড়িয়ে চলাই উত্তম।
এ সমস্ত অভ্যাসগুলো আপনাকে সাহায্য করবে হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে। তাই আজ থেকেই চেষ্টা করুন এই অভ্যাসগুলো মেনে চলার।
