
নাসিরউদ্দীন হোজ্জার একটি গল্পে বর্ণিত আছে, রাজা একবার হোজ্জার কাছে জানতে চান কোন ধরণের মানুষ বেশি তাঁর রাজ্যে। হোজ্জা কৌতুক করে বলেছিলেন চিকিৎসক এবং তিনি প্রমাণ করেছেন যে আসলেই আমরা সুযোগ পেলে অন্যকে চিকিৎসকের মতো পরামর্শ দেই। সকলেই একে অপরকে চিকিৎসা পরামর্শ দেই বা নিজেই নিজের চিকিৎসা করি। কিন্তু এভাবে রোগীর কতটুকু উপকার হচ্ছে বা আমরা নিজেরা যখন প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করছি তা আমাদের শরীরে কীরকম সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে তা কি কখনো আমরা ভেবে দেখেছি? সর্দি-কাশি, এলার্জি জনিত যে কোনো অসুখে অনেকের স্বভাব আছে এন্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ার। আবার পূর্বে খেয়েছে এমন এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করে যখন আবার কোনো অসুখ হয়। এভাবে পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ গ্রহণ আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এমন এক পর্যায়ে যেখানে আমরা রোগের কোনো নিরাময় করতে না পেরে অনেকে অকালে মারা যাবো। এন্টিবায়োটিক নিয়ে আমাদের ভ্রান্ত ধারণা এবং যথেচ্ছা ব্যবহার আমাদের জন্য প্রতিকার নাকি মরণফাদ তারই উত্তর খুঁজবো আমরা।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর পেনিসিলিন এন্টিবায়োটিক উদ্ভাবন ছিলো একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ব্যাক্টেরিয়া জনিত অনেক মরনব্যাধি রোগ এবং ইনফেকশনগুলোর প্রতিকার করে অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছে এই এন্টিবায়োটিকগুলো। পরবর্তীতে এন্টিবায়োটিকের ব্যাপক বাজারজাত করা শুরু হয় এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাতারাতি মানুষের চিকিৎসার ক্ষেত্রে। কিন্তু এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে জীবানুগুলো বা ব্যাক্টেরিয়াগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচন, মিউটেশন এর মাধ্যমে তৈরি করে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স (Brooks, 2015)। WHO এর মতে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স শুধুমাত্র ভবিষ্যতের জন্য কোনো অশনি বার্তা নয় এটি বর্তমানের জন্য আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। যার কারনে আমরা দেখতে পারছি বর্তমানে এন্টিবায়োটিক তাঁর কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে এবং হুমকির মধ্যে পড়েছে মানুষের জীবন।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স তৈরি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারনের মধ্যে অন্যতম হলো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করা। একটি এন্টিবায়োটিকের নির্দিষ্ট ডোজ থাকে এবং নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে পুরো পৃথিবীতে ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কিনে থাকেন। (Cars, 2005; Nordberg, 2005) পাশাপাশি এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপে ২২ থেকে ৭০ শতাংশ পিতা-মাতার মধ্যে এন্টিবায়োটিকের যথার্থ ব্যবহার নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে। (Belongia, 2002; Naimi, 2002; Gale, 2002; Besse , 2002) একজন রোগী যখন রোগের সামান্য উন্নতি দেখে এন্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স সম্পন্ন না করে মাঝ পথে ছেড়ে দেয় তখন রোগীর শরীরে ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস না হয়ে অনেক সময় দুর্বল অবস্থায় থাকে এবং এই দুর্বল হয়ে যাওয়া ব্যাক্টেরিয়াগুলোই এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। পরবর্তীতে যখন সেই এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা হয় তখন আর সেটি কার্যকর হতে পারেনা রোগীর দেহে। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করলে যেমন, ভাইরাসজনিত সর্দি-কাশি হলে তখন এন্টিবায়োটিক খেলে রোগীর দেহে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স তৈরি হয়ে থাকে। তাই প্রেসক্রিপশন ছাড়া, নিজ সিদ্ধান্তে কখনো এন্টিবায়োটিক কিংবা অন্যান্য ওষুধ গ্রহণ করা উচিত নয়। সম্প্রতি দি টেলিগ্রাফ এর ২২ এপ্রিলের সংখ্যায় উঠে এসেছে এক তথ্য যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আইসিইউ (ICU) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ শতাংশ রোগী এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের কারনে মারা গিয়েছে। প্রফেসর সায়েদুর রহমান বলেছেন দি টেলিগ্রাফকে যে, ৯০০ রোগী আইসিইউ’তে ভর্তি হয়েছে ২০১৮ সালে এবং ৪০০ রোগী মারা গিয়েছে। এর পিছনে ভূমিকা পালন করছে রোগীদের দুর্বল ইমিউনিটি সিস্টেম। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, বাংলাদেশে যাচ্ছেতাই এন্টিবায়োটিক সেবন করার ফলাফল কীরকম ভয়ানক আঁকার ধারণ করেছেন।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ৭২টি দেশের নদীর নমুনা গবেষণা করে দেখেছে যে নদীর পানিগুলো ৬৫ শতাংশ এন্টিবায়োটিক দ্বারা দূষিত। আর এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবথেকে শোচনীয় বলে ধারণা করা হয়েছে! এই পানি ব্যবহারের মাধ্যমে বা এই পানির মাছ থেকে আমাদের দেহে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শরীরে প্রবেশ করছে এবং আমাদের দেহে গঠিত হচ্ছে এন্টিবায়োটিক বিরোধী প্রতিরোধ। গবেষনায় ধারণা করা হয়েছে ২০৫০ সালে ১০ মিলিয়ন মানুষ এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স এর কারনে মারা যাবে এবং বাংলাদেশও এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। (de Kraker, 2016; Stewardson, 2016; Harbart, 2016)
তাই দেখা যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমাদের অবসাবধানতা আমাদের মানবজীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। কার্যকারিতা হারিয়েছে পেনিসিলিন, রিফাম্পিসিন, কুইনোলন এর মতো জীবনরক্ষাকারী এন্টিবায়োটিকগুলো। যেখানে এন্টিবায়োটিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে ছিলো একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার তেমনি বর্তমান প্রেক্ষাপটে এন্টিবায়োটিক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য মরণফাদ। এই মরণফাদে পা দিতে না চাইলে আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বা এন্টিবায়োটিক বিক্রয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এই বিষয়ে জাতীয় নীতিমালাও প্রয়োজন। সামাজিকভাবে আমাদের সচেতন হতে হবে ওষুধ গ্রহনের ক্ষেত্রে। অসুস্থ হলে প্রথমে চিকিৎসক এবং একমাত্র তার পরামর্শেই ওষুধ সেবন করার প্রবনতা গড়ে তুলতে হবে। পরিবারের জ্যেষ্ঠ কারো পরামর্শে ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এই ব্যাপারে অন্য মানুষকেও সচেতন করে তুলতে হবে। সর্বোপরি ব্যক্তি নিজের মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি করতে হবে এবং সচেতন হতে হবে নিয়মমাফিক এন্টিবায়োটিক সেবন এবং ফুল কোর্স সম্পাদন করার জন্য। তাহলে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টন্স থেকে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হতে পারে। বিজ্ঞানীরাও নতুন ধরনের এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স এর আসন্ন ভয়াবহতা আমরা মোকাবেলা করতে পারবো।
তথ্যসূত্রঃ
Brooks M (16 November 2015). "Public Confused About Antibiotic Resistance, WHO Says". Medscape Multispeciality
Cars O, Nordberg P. (2005). Antibiotic resistance –The faceless threat. Int J Risk Saf Med; 17: 103-10.
Belongia EA, Naimi TS, Gale CM, Besser RE. (2002). Antibiotic use and upper respiratory infections: a survey of knowledge, attitudes, and experience in Wisconsin and Minnesota. Prev Med ; 34: 346-52
de Kraker MEA, Stewardson AJ, Harbarth S (2016) Will 10 Million People Die a Year due to Antimicrobial Resistance by 2050? PLoS Med 13(11)